তাঁতশিল্পঃ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
টেক্সটাইল

তাঁতশিল্পঃ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

বাংলার মসলিন বাগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন!”
– পৃথিবীব্যাপী বাংলার তাঁতের কাপড়ের সুখ্যাতির জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একদা এমনটা লিখেছিলেন।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পগুলোর মধ্যে তাঁতশিল্প অন্যতম। তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতা থেকে কাপড় বানানো যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তারাই হচ্ছেন হালের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার।

 

অতীত ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চল, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, ঢাকার ধামরাই এবং প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। আরো জানা যায় যে, মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে তাঁতশিল্পের বস্ত্র তৈরি করে আসছে। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছিল। আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে টাঙ্গাইলে তাঁতশিল্প প্রসার পায়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতীদের বংশধর। শুরুতে তারা নকশাবিহীন কাপড় তৈরী করলেও পরবর্তীতে নকশা সহ কাপড়ের কাজ শুরু করেন।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প

 

এদেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প কুটির শিল্প হিসেবে বৃটিশ পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বরং দেশের বাইরের বাণিজ্যেও তাৎপর্যপূর্ণ স্থান দখল করেছে। বংশ পরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যদিয়ে তাঁতীরা সৃষ্টি করেছে এক বিশেষ স্থান। কিন্তু বৃটিশ আমলে তাঁত ব্যবহারের উপর আরোপিত নানা বিধি-নিষেধ, অসম করারোপ, বৃটিশ বস্ত্রের জন্য বাজার সৃষ্টির নানা অপকৌশলের কাছে বাংলার তাঁতী সমাজ তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে অপারগ হয়। আর স্বাধীনতা পরবর্তী বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির আড়ালে একরকম পরোক্ষ আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে দেশীয় তাঁতশিল্প। বিভিন্ন ধরণ, বিভিন্ন রং এবং বিভিন্ন ডিজাইনের বিদেশি কাপড়ের অবাধ প্রবেশের ফলে বাজার চলে গেছে সনাতনী তাঁতীদের প্রতিকূলে। চলমান মুদ্রা অর্থনীতির প্রসারের ফলে দেখা দিয়েছে পুঁজি সংকট। অধিকাংশ প্রান্তিক তাঁতী ও তাঁত মালিকেরা পড়েছেন ব্যাপক বিপাকে। সুতা, রং ও রসায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের অভাব বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এদেশের তাঁতীদের জন্যে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিহার্য। হস্তচালিত তাঁতশিল্প এদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। সরকার কর্তৃক সম্পাদিত তাঁতশুমারী ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লক্ষাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। দেশের মোট কাপড়ের চাহিদার শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ যোগান দিচ্ছে তাঁত শিল্প এবং বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ তাঁতী, মালিক ও ব্যবসায়ী-ক্রেতা এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত।
কালের বিবর্তনে পোশাকের রকম ও ধরণে নানা পরিবর্তন এলেও আমাদের দেশে নিজস্ব পোশাক ছাড়া নিজস্ব সভ্যতাকে কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। আর এই নিজস্ব পোশাক নিয়েই কাজ করে চলেছে বাংলাদেশের তাঁতিরা। বাস্তবতা হলো অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত থাকার পরেও দেশের বিভিন্ন জেলার তাঁতশিল্পের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তাঁতের নানা ধরনের কাপড় তৈরি করে চলেছেন। আর তাঁত এবং তাঁতিদের সঙ্গে নিয়েই ‘তাঁতশিল্প’ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁত, রঙ ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও পরিবহন সুবিধার অব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশীয় এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ কারণে অনেক তাঁতী এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে এবং অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
তাঁত আমাদের কৃষ্টি, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। আর নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে থাকাটাও অবশ্যই গর্বের বিষয়। আসুন আমরা দেশীয় তাঁতশিল্পের পণ্য ব্যবহার করি, দেশের ঐতিহ্য কে রক্ষা করি।
* তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
* আলোকচিত্রঃ টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী পরিদর্শনকালে নিজস্ব ক্যাপচার

Author: T. Mahmud Ornab

Jahangirnagar University

Department of English

You May Also Read: 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *