আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি। অন্যান্য শতাব্দীর সাথে এই শতাব্দীর বড় একটা পার্থক্য, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নামের আগে যুক্ত হচ্ছে ‘স্মার্ট’ শব্দটি। যেমন: স্মার্ট টেক্সটাইল, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, স্মার্ট ফ্রিজ, স্মার্ট হোম ইত্যাদি।
এককালে টিভি দেখতে প্রয়োজন হতো বিশাল লম্বা অ্যান্টেনার। এখন সে জায়গা দখল করেছে স্মার্ট টিভি। বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোনের ওজন ছিল এক কেজিরও বেশি! আর এখন সবাই স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে ঘুরি। অর্থাৎ, প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সাথে সাথে সবকিছুই স্মার্ট হয়ে উঠছে। তাহলে আমাদের পোশাক স্মার্ট হওয়া থেকে বাদ থাকবে কেন!
আদিমকালে মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের পাতা, ছাল-বাকল ও পশুর চামড়াই ছিল সম্বল। এরপর সুতা আবিষ্কার হলো, গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা হলো। মানুষ বাহারি রঙের পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তুললো। তবে সময়ের সাথে সাথে পোশাকের বিবর্তন হয়েছে।
২০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পোশাক পড়ত, সেটা এখন আমাদের কাছে সেকেলে মনে হয়। ঠিক তেমনি এখন থেকে আরও ২০০ বছর পর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বর্তমানের পোশাকও সেকেলে মনে হবে। কারণ, সময়ের পরিক্রমায় প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় আমাদের পরিধেয় পোশাক এখন শুধু পরিধানের বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানেও নানা প্রযুক্তি যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।
বিভিন্ন ফিচার, সুযোগ-সুবিধা যুক্ত হওয়ায় পোশাককে অভিহিত করা হচ্ছে স্মার্ট টেক্সটাইল বা স্মার্ট ফেব্রিক নামে। প্রযুক্তিবিদরা একে বলছেন, ওয়্যারেবল টেকনোলজি (Wearable Technology) বা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি।
.
যেমন হবে আমাদের ভবিষ্যতের পোশাক:
স্মার্ট টেক্সটাইলের মার্কেট এখনো খুব প্রসার না ঘটলেও ইউরোপের দেশগুলোতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। স্মার্ট পোশাক নিয়ে সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ফ্যাশন শো চলছে। সেখান থেকেই একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছে যে, আমাদের ভবিষ্যতের পোশাক কেমন হতে পারে। সংক্ষেপে তুলে ধরলাম:
* কাপড়ের রং বদলে ফেলা সম্ভব হবে:
কেমন হবে, যদি এক রঙের কাপড় পরে ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া মাত্রই সেই কাপড়ের রং পাল্টে যায়? এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও খুব দ্রুত এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে।
একটি মোবাইল আপ্লিকাশনের মাধ্যমে কাপড়ের রং পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।
* অন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে চার্জ দেওয়া যাবে:
আপনার কাপড় থেকে আপনার মোবাইল ফোন চার্জ দিতে পারবেন। ফোনকে চার্জ দিতে পারে, এমন জ্যাকেট ইতোমধ্যে ইউরোপের বাজারে চলে এসেছে। সেই জ্যাকেটের সাথে ছোট সাইজের একটি ব্যাটারী এবং পিঠের দিকে সোলার প্যানেল সংযুক্ত করা আছে। সাধারণ চলাচলের মাধ্যমেই ঐ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ব্যাটারী চার্জ হবে, যাতে আপনি আপনার মোবাইল যুক্ত করে তাতে চার্জ দিতে পারবেন। সেইদিন হয়তো খুব বেশি দূরে না, যখন আমাদের শরীরে উৎপন্ন তাপ থেকেই অন্য ডিভাইসগুলোকে চার্জ দেবার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবে।
* যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে:
আমাদের ভবিষ্যতের পোশাকগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হবে। তখন আমাদের অনেক কাজ আমাদের পোশাকগুলোই করে দিতে পারবে। যেমন: ছবি তোলা, ফোন সাইলেন্ট করে দেয়া, কল রিসিভ করা বা কেটে দেয়া, এমনকি লাইট বা ফ্যান চালু করা বা বন্ধ করা ইত্যাদি।
* শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে:
আমাদের পোশাক পরিস্থিতি বুঝে শরীরের তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। আপনি এখন হয়তো ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে বাসে বসে ঘামছেন, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসে ঠান্ডা এসির মধ্যে প্রবেশ করছেন। তাপমাত্রার এই হুটহাট পরিবর্তন শরীরের জন্য বেশ অস্বস্তিদায়ক। আবার অনেকে হয়তো তীব্র গরম সহ্যই করতে পারেন না, কেউ আবার হালকা শীতেই বরফ হয়ে যান। অদূর ভবিষ্যতে এমন পোশাক আসবে, যা আপনার চাহিদামতো তাপমাত্রা বজায় রাখবে। এর ফলে শরীরে দুর্গন্ধ কিংবা ঘামের সৃষ্টি হবে না। শুধু তাই নয়, পোশাকের ভেতরে থাকা চিপগুলো আপনার ঘরের এসির কাছে তথ্য পাঠিয়ে দেবে যেন আপনি ঘরে ঢোকার মুহূর্তে আপনার পছন্দের আরামদায়ক তাপমাত্রা পান!
* পোশাকের সাইজই পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হবে:
পোশাক ছোট না বড়, ফিট হলো কি না, এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আর দুশ্চিন্তা করা লাগবে না। কারণ তখন পুরো পোশাকের আকৃতি বদলে ফেলা যাবে!
* নিজে নিজেই পরিষ্কার হয়ে যাবে পোশাক!
আপনি একটি পোশাক পরেছেন, কিন্তু সেটা ধোয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। মানে পোশাকটা আপনা-আপনি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এটাও কি সম্ভব? অসম্ভবের কিছু নেই! Self-cleaning technology হলো সেই প্রযুক্তি, যেখানে পোশাক অটোম্যাটিক পরিষ্কার হয়ে যায় এবং অনেকদিন ব্যবহার করা যায় না ধুয়েই!
* বর্তমানে পরীক্ষার-নিরীক্ষার পর্যায়ে থাকলেও স্মার্ট স্পোর্টসওয়্যার বিক্রি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এইসব পোশাক পরা অবস্থায় পোশাকই বলে দিতে পারে পরিধানকারীর হার্টরেট কত, রক্তচাপ ও দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক কি না ইত্যাদি।
স্মার্ট টেক্সটাইল কী নতুন কোনো কিছু?
না, স্মার্ট টেক্সটাইলের ধারণা নতুন কিছু নয়। প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞরা এই ধারণাটি নিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনা করে যাচ্ছেন। আর এটি নিয়ে প্রথম আলোচনা করা হয় ১৯৮৯ সালের দিকে। কানাডিয়ান প্রকৌশলী স্টিভ মান সর্বপ্রথম স্মার্ট টেক্সটাইলের ধারণা প্রদান করেন। আর তাই তাকে ই-টেক্সটাইল বা স্মার্ট টেক্সটাইলের জনক বলা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, “এক সময় আমাদের পোশাকগুলো আমাদের অনুভূতি বুঝতে পারবে।”
স্মার্ট টেক্সটাইলের ভবিষৎ:
ই- টেক্সটাইল অর্থাৎ কাপড়ে পরিধানযোগ্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের চাহিদা এখন ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো স্মার্ট পোশাক তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সার্চইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল স্মার্ট পোশাক তৈরিতে নেমে পড়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্যাশনোলজি সামিটের আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১৫টি দেশের ৪১ জন বিশেষজ্ঞ আলোচক অংশ নেন এই আয়োজনে। তাঁরা স্মার্ট পোশাকের ভবিষ্যৎ বাজারের নানা বিষয়ে কথা বলেন। আলোচকরা বলেন, “স্মার্ট দুনিয়ার পোশাক-আশাক স্মার্ট হতে শুরু করেছে। নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো স্মার্ট পোশাক তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে থাকলেও স্মার্ট পোশাকের বৈশ্বিক বাজার বর্তমানে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৫ সালে এই বাজারের পরিসর বেড়ে ১৩ হাজার কোটি ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানিতে টিকে থাকতে হলে স্মার্ট পোশাক তৈরি ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট টেক্সটাইল:
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের অর্থনীতি টিকে আছে গার্মেন্টস সেক্টরের উপর। চীনের পর আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারলে মার্কেট থেকে ছিটকে যেতে হয়। পূর্বে আমরা দেখেছি যে, বিশ্ববিখ্যাত অনেক পণ্য বা কোম্পানি মার্কেট থেকে হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে আপডেট হতে না পেরে। স্মার্ট টেক্সটাইল নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশী কিছু প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেক্সটাইল নিয়ে কাজ শুরু করেছে। গতানুগতিক আমরা যে ধরনের পোশাক রপ্তানি করে থাকি, এর সাথে স্মার্ট টেক্সটাইল খাতটি যুক্ত হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে
স্মার্ট টেক্সটাইল সহজলভ্য হবে কবে?
উপরে যে ব্যাপারগুলো বলা হলো, আমাদের কাছে এখন তা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে ভেবে দেখুন, আজ আমরা যেসব প্রযুক্তি ভোগ করছি, বিশ বছর আগে কিন্তু আমরা এমনটা কল্পনা করিনি! আবার দশ বছর পর হয়তো আমরা এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করবো, যা আমরা এখনো ভাবতেই পারছি না। স্মার্ট টেক্সটাইল নিয়ে বড় ধরনের কাজ শুরু হয়েছে। হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই আমাদের সাধারণ গার্মেন্টসগুলো স্মার্ট গার্মেন্টসে রূপান্তরিত হবে।
স্মার্ট টেক্সটাইলের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে?
প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্যেরই কিছু না কিছু খুঁত বা সীমাবদ্ধতা থাকে। উচ্চ মূল্য ও পর্যাপ্ত মূল্যায়নের অভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে স্মার্ট টেক্সটাইল। প্রথম দিকে হয়তো শুধু উচ্চবিলাসী ধনীরাই এই পোশাক ব্যবহার করবে। কিন্তু একসময় এটা সবার জন্যই সহজলভ্য হয়ে যাবে। বর্তমানে যেটা স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। একসময় স্মার্টফোনের প্রচুর দাম ছিল, কিন্তু এখন কয়েক হাজার টাকা হলেই ভালোমানের স্মার্টফোন পাওয়া যাচ্ছে।