পশতুন সংকট হল দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদি, জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পশতুন জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার, সন্ত্রাসবাদ, সীমান্তবিরোধ, ও দ্বৈত-রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো। পশতুনরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানজুড়ে বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিস্তৃত, কিন্তু তাদের জাতিগত অঞ্চল ১৮৯৩ সালের দুরান্ড লাইন চুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভাজন, এবং দুই দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ও নিরাপত্তা বাস্তবতা, পশতুন সংকটকে আজও অমীমাংসিত রেখেছে।
✅ ১. ঐতিহাসিক ভিত্তি: দুরান্ড লাইন বিভাজন (১৮৯৩)
পশতুন সংকটের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৮৯৩ সালে, যখন ব্রিটিশরা আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে দুরান্ড লাইন নামে ২,৬৪০ কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করে।
- এই সীমান্ত পশতুন এলাকা কেটে দুইভাগে ভাগ করে দেয়।
- আফগানিস্তান কখনোই এই সীমান্তকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
- পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র গঠনের পর দুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে দাবি করে।
ফলে পশতুন জনগোষ্ঠীর পরিচয়, প্রশাসন, ভূমি, ও রাজনৈতিক অধিকার—সবই দুই দেশের কেন্দ্রীয় নীতি দ্বারা ভিন্নভাবে পরিচালিত হতে থাকে।
✅ ২. পশতুন পরিচয় সংকট: জাতিগত vs রাষ্ট্রীয় পরিচয়
পশতুনরা নিজেদের পরিচয় প্রধানত “পশতুন” হিসেবে মানে—ধর্ম, ভাষা, উপজাতীয় কোড (Pashtunwali) এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা—সবকিছু তাদের জাতিগত আত্মপরিচয়ের অংশ।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামো তাদের এই পরিচয়ের সাথে প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ঃ
- পাকিস্তানে পশতুনরা চাই “অধিক রাজনৈতিক অধিকার, উন্নয়ন ও স্বায়ত্তশাসন।”
- আফগানিস্তানে পশতুনরা বহু বছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও অভ্যন্তরীণ বিভাজনে ভোগে।
এই পরিচয় দ্বন্দ্ব সংকটকে আরও জটিল করে।
✅ ৩. সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও সীমান্তের অরক্ষিত বাস্তবতা
পশতুন অধ্যুষিত অঞ্চল, বিশেষ করে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া–FATA অঞ্চল, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এই শূন্যতা পূরণ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীঃ
- আফগান তালেবান
- TTP (Tehrik-e-Taliban Pakistan)
- হাক্কানি নেটওয়ার্ক
- আল-কায়েদার অংশ
এই গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পশতুন সমাজকে বারবার যুদ্ধ, স্থানচ্যুতি, সহিংসতা, এবং আন্তর্জাতিক সামরিক অভিযানের মুখোমুখি করেছে।
পাকিস্তানে পশতুনদের অবস্থান: বঞ্চনা, বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ
পাকিস্তানে পশতুন অধ্যুষিত অনেক অঞ্চল, বিশেষ করে FATA, বহু বছর ধরে আধুনিক প্রশাসনের বাইরে ছিল।
-
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে
-
সামরিক অভিযান, টার্গেট কিলিং ও জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ
-
রাজনৈতিক অধিকার সীমিত
-
উন্নয়ন প্রকল্পের অভাব
এর ফলে পশতুনদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ জন্মায় এবং “পরিধিবদ্ধ নাগরিকত্বের” অনুভূতি তৈরি হয়।
আফগানিস্তানে পশতুনদের ভূমিকা: ক্ষমতা ও বিভাজন
যদিও আফগানিস্তানে পশতুনরা বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী, তবে তারা অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত।
-
দক্ষিণাঞ্চলের পশতুনদের মধ্যে তালেবান আদর্শ জনপ্রিয়
-
পূর্বাঞ্চলে উপজাতীয় নেতাদের আধিপত্য
-
ক্ষমতার লড়াইয়ে তাজিক, হাজারা, উজবেকদের সঙ্গে বহুবার সংঘাতে জড়িয়েছে
পশতুনদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন আফগানিস্তানের জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করেছে।
✅ ৪. পাকিস্তান–আফগানিস্তান পারস্পরিক অভিযোগ
পশতুন সংকট দুই দেশকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে বাধ্য করেছে।
আফগানিস্তানের অভিযোগ:
- পাকিস্তান পশতুন সীমান্ত অঞ্চল ব্যবহার করে তালেবানকে সহায়তা করেছে।
- পাকিস্তান তালেবানকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে (Quetta Shura, Peshawar Shura)।
- পাকিস্তানের “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” নীতি আফগান সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
পাকিস্তানের অভিযোগ:
- আফগানিস্তান TTP-কে আশ্রয় দিচ্ছে।
- সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষায় আফগানিস্তান সহযোগিতা করে না।
উভয়পক্ষের অভিযোগে পশতুন অঞ্চল ক্রমাগত “প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র”-এ পরিণত হয়েছে।
✅ ৫. পশতুনদের উন্নয়নবঞ্চনা ও প্রশাসনিক বৈষম্য
- পাকিস্তানের FATA অঞ্চল বহু দশক ধরে উপনিবেশিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে চলে, যেখানে আধুনিক প্রশাসন, আদালত, অবকাঠামো ছিল না।
- আফগানিস্তানে পশতুন অঞ্চল দীর্ঘসময় যুদ্ধক্ষেত্র থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি–কর্মসংস্থান সবই দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফলে পুরো পশতুন বেল্ট দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়ে যায়।
✅ ৬. Pashtun Tahafuz Movement (PTM) – আধুনিক পশতুন পরিচয় আন্দোলন
২০১৮ সালে পাকিস্তানে উদ্ভব হয় PTM, যার নেতৃত্বে ছিল মানজূর পশতুন।
তাদের মূল দাবি:
- নিরাপত্তা বাহিনীর হয়রানি বন্ধ
- গুম হওয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনা
- চেকপোস্ট ও সামরিক দমন বন্ধ
- বেসামরিক অধিকার নিশ্চিত করা
PTM পশতুন সংকটের আধুনিক রাজনৈতিক রূপ, যা পুরো অঞ্চলে পশতুন অধিকার দাবিকে নতুন মাত্রা দেয়।
✅ ৭. কেন পশতুন সংকট সমাধান কঠিন?
(১) সীমান্ত স্বীকৃতি বিরোধ
আফগানিস্তান দুরান্ড লাইন মানে না → সমস্যা স্থায়ী।
(২) উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা
তালেবান–TTP–হাক্কানি নেটওয়ার্ক জটিলতা আরও বাড়ায়।
(৩) দুই দেশের অবিশ্বাস
দুই দেশের নিরাপত্তা নীতি পরস্পরবিরোধী।
(৪) বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ
সোভিয়েত, যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব।
(৫) জাতিগত রাজনীতি
পশতুনদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।
✅ সংক্ষেপে, পশতুন সংকটের মূল
✅ ঐতিহাসিক বিভাজন (দুরান্ড লাইন)
✅ সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা সংকট
✅ জাতিগত পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের দ্বন্দ্ব
✅ উন্নয়ন ও রাজনৈতিক অধিকার সংকট
✅ পাক–আফগান পারস্পরিক অভিযোগ
✅ আন্তর্জাতিক শক্তির জড়িত থাকা
Top 10 Line
- পশতুন সংকটের মূল শিকড় দুরান্ড লাইন বিভাজন।
- আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে পশতুন জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতা জাতিগত টানাপোড়েন তৈরি করেছে।
- পশতুন এলাকা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
- তালেবান, TTP, হাক্কানি নেটওয়ার্ক এখানেই শক্তিশালী হয়েছে।
- পাকিস্তানের “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” নীতি আফগানিস্তানের ক্ষোভ বাড়িয়েছে।
- আফগানিস্তান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তালেবান আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে।
- পাকিস্তান মনে করে আফগানিস্তান TTP-কে আশ্রয় দিচ্ছে।
- পশতুন এলাকায় উন্নয়নবঞ্চনা সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে।
- PTM আধুনিক পশতুন অধিকারের আন্দোলন।
- সংকট সমাধান কঠিন কারণ এটি সীমান্ত, পরিচয়, নিরাপত্তা ও রাজনীতির সমন্বিত সমস্যা।
