বেঁচে থাকা

কাশিমপুর কারাগার; চারশত চার নাম্বার সেল। যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আসামি সেলিম।মার্ডার কেস এর প্রমাণিত আসামি।বিচারক হয়ত দয়া করেই ফাঁসির জায়গায় এই দন্ড দিয়েছে;প্রথম প্রথম সেই দয়াকে সৃষ্টিকর্তার করুণা ভাবলেও দীর্ঘ ১৫ বছর জেল জীবনে এখন সেটা সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলেই মনে হয় তার। মুক্তির আশা নেই; বাকি জীবনটা হয়ত জেলেই কাটবে তার।

৪০৪ ও ৪০৮ নম্বর মুখোমুখি দুটি সেল; এই ১৫ বছরে কত আসামির যাওয়া আসার স্বাক্ষী সে। কোনো আসামি আসলেই সেলিম মুক্তি জীবনের গল্প শোনে; এবারের ঘটনা আলাদা। ৪০৮ সেলে মৃত্যু দন্ডের আসামি তারেক আসে; নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত সব খানেই স্ত্রী হত্যার দায়ে ফাঁসি বহাল। শুধুু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের রায়টাই দেয়া বাকি। সেলিম তারেকের কথা হয়। তারেকের সব ঘটনা শুনে হয়ত সেলিম ও তার নিজের আদালতে তারেকের ফাঁসির রায় বহাল রাখে।তারেকের দিকে চেয়ে তার ভাবনা হয়; কতবার নিজের আদালতেই নিজেকেই সে ফাঁসি দিয়েছে।কিন্তু বারবার দেয়া সে ফাঁসিতে তার মৃত্যু হয় নি; সেলিম মৃদু স্মরে বলে তোমারই ভালো। তারেকের মুখে শূন্যতার প্রাপ্তি নিয়ে হালকা হাসি ফোটে। সেলিম মেঝেতে বসে শেকলে মাথা ঠুকে বলে;-এই সারাজীবন বন্দী থাকার চেয়ে মৃত্যুদণ্ডই হালকা শাস্তি। তাতে দেহ না হলেও আত্মা তো মুক্তি পায়; বন্দির থেকে ওটাইতো ঢের ভালো।

তারেক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করে আপনি মৃত্যু কামনা করেন? সেলিমের সম্মতি সুচক স্মর শুনে তারেক বলে;- ঐ যে শিকল দেখছেন; ওখানে সর্বশক্তি দিয়ে খালি হাতে আঘাত করেন দেখি।

সেলিম কপাল কুচকে বলে;- ওতে পাগলেও মারবে না। হাতের দিকে তাকিয়ে বলে; ইচ্ছে করে হাত কেনো হারাবো? যার হাত নেই সে জানে হাতের মূল্য কত। তারেক জীতে যাওয়ার ভঙ্গীতে অট্ট হাসি দিতে থাকে।

জীবনে কী বেশি গুরুত্বপূর্ণ সুখবিলাস নাকি কষ্ট মুক্তি?

যদি বলি, বেচেঁ থাকা!

কয়েকজন উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা আশায় হাসি থামে তার; তারেককে বলে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল। কালকের মধ্যেই তোমার রায় কার্যকর হবে। আজকে নামাজ দোয়া করে নিয়ে..; কথা শেষ না করেই এক দারোগা কে নির্দেশ দেয় তাকে অন্য সেলে নিয়ে আজকেই সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার। তারেককে ৪০৮ থেকে বের করে বলা হয় চলো। তারেকের আর সেলিমের দুজনের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।তারেখ একটু সামলে নিয়ে; স্যার! আমার ৪০৪ সেলের আসামির সাথে শেষ একটা কথা আছে।বিনয়ের সুরে বলল সুযোগ দিন স্যার। তারেককে গার্ড দিয়ে ৪০৪ সেলের সামনে আনা হলে শিকলের এপাশ থেকে তারেক ফিসফিসিয়ে সেলিম কে কিছু বলেই কেঁদে উঠে। তারপর বলে;- “বেচেঁ থাকবেন”।

৪০৮ নম্বর সেল তালা লাগিয়ে তারেককে নিয়ে যাওয়া হয়; ফাঁকা থাকে ৪০৮ নম্বর সেল। সেলিমের এত দিনের বন্দি থাকার কষ্ট যেন নিমিষেই তারেকের কাছে হার মেনে যায়।

সেলিম নিজেকে তারেকের অবস্থায় বসায়; সব ভাবনার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে সেলিম। তার স্বপ্নে সে নিজেকে ফাঁসির মঞ্চে আবিষ্কার করে। জল্লাদ তার মাথায় কালো কাপড় পড়ায়;- অন্ধকার দেখায় সব। তার কাছে এই অন্ধকার টাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলো মনে হতে থাকে।ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ানো হয় তার। সে চিৎকার করে বলে আমাকে আর কিছুক্ষণ বাঁচতে দাও। এই পৃথিবীর অন্ধকার টা একটু চোখ জুড়ে দেখতে দাও।কেউ শোনে না তার চিৎকার। ভয় পেয়ে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে গ্লাসে থাকা পানি খায়।অন্ধকার আর দেয়াল গুলো তার কাছে নতুন মনে হয়।

৪০৮ নম্বর ফাঁকা সেলের দিকে তাকায় সেলিম আর মনে মনে ভাবে তারেকের বলে যাওয়া কথা- “যার হাত নেই সে যেমন বোঝে হাতের মূল্য কত। তেমনি যার জীবন চলে যায় সে জানে বেচেঁ থাকার মূল্য কত।জীবনের মূল্য সব চেয়ে আলাদা।বেচেঁ থাকবেন।” অজান্তেই গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছতে মুছতে অস্ফুট স্মরে ৪০৮ নম্বর সেল কে প্রশ্ন করে, -জীবনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কী? দেয়াল থেকে উত্তর আসে, –(বেচেঁ থাকা!)

Author:

ফুয়াদ হাসান শাওন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

১৫ তম ব্যাচ

You may also read

আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ লাইক করুন। এবং জানতে থাকুন নতুন ও আশ্চর্যজনক তথ্যসমূহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Asif Hossain
Asif Hossain

" Unlock Your Creative Potential "